একটি গল্প, শুধু অবিবাহিতদের জন্য, ভিডিও এবং পোস্ট সম্পূর্ণ দেখার পর বুঝে যাবেন ইনশাআল্লাহ।
দ্বীনদার পাত্রীপক্ষের কাছ থেকে রিজেক্ট হয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন। এই ব্যাপারে শায়খ সালাহউদ্দীন মাক্কী (হাফি.) অর্ধেক দ্বীন পেজের লাইভ দারসে কিছু মূল্যবান আলোচনা করেন। যা দেখলে অনেকের কিছুটা হলেও উপকার হবে ইন শা আল্লাহ।
ভালো করে বোঝার জন্য এই ভিডিওটি দেখুন কাট করে কম সময়ে মূল কথাটা বুঝার জন্য সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
পুরো লাইভ দারসটি ছিল অনেক ইনফরমেটিভ। যারা দেখেননি তারা এখান থেকে দেখে নিতে পারে,
“বিবাহর পূর্বের প্রস্তুতি ও শারয়ী নির্দেশনা”
আলোচনায় - শাইখ সালাউদ্দিন মাক্কী
তৃতীয় প্রজন্মের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ সুফিয়ান সাওরী (রহ.)। তাঁর এক বন্ধু ছিল বসরায়। সেই বন্ধু প্রায়ই তাঁর বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করত। একদিন সুফিয়ান রাজি হয়ে বললেন, 'আচ্ছা যাও, বিয়ে করব।
সুফিয়ান মক্কার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন। এদিকে তাঁর বন্ধু বসরার সম্ভ্রান্ত, ধনাঢ্য এক পরিবারের মেয়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেল সুফিয়ানের জন্য। সুফিয়ান সাওরী। হয়ত তাদের মতো ধনী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর কাছে যেটা ছিল, সেটা হচ্ছে ইলমের ভাণ্ডার। তিনি তৎকালীন যুগের একজন ইমাম ফিকহ ও হাদীসের। চারিদিকে তাঁর নাম ডাক ছিল। মানুষ দূর দূরান্ত থেকে আসত তাঁর ইলমের বিশাল সাগর থেকে একটু সুধা পান করতে।
.
যাইহোক সেই পরিবার রাজি হলো। তারা প্রয়োজনীয় অর্থ সম্পদ নিয়ে হাজির হলো মক্কায়। কারণ, সেসময় সুফিয়ান (রহ.) মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তিনি জানেন না তার বন্ধু ভিতরে ভিতরে এই পরিবারের কাছে প্রস্তাব নিয়ে রাজি করিয়ে ফেলেছে।
তো সেই বন্ধু সুফিয়ানকে বলল, “আমি কি আপনার পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিব?”
- কাকে?
- অমুকের মেয়েকে।
- না, তাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
- তারা তো রাজী হয়ে গেছে!
- তাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
- তুমি তো তাদের সামনে আমাকে অপমানিত করে ছাড়বে!
- বললাম তো, তাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
- কিন্তু এখন আমি কীভাবে কী করব?!
- তাদের গিয়ে বলো— তাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
বন্ধু ফিরে গিয়ে তাদেরকে বিষয়টা জানালেন পরিবারকে। পাত্রির কানে গেল কথাটা।
সে জানতে চাইল, ”উনি কী কারণে আমাকে পছন্দ করলেন না—জানতে পারি?”
বন্ধু বলল,
‘আপনাদের সম্পদের প্রচুর্যের কারণে।’
মহিলা বলল, ’আমি আমার সব সম্পদ ছেড়ে দিয়ে তার সাথে দুনিয়াবিমুখ জীবনে ধৈর্যধারণ করতে রাজী।’
বন্ধু খুশি হয়ে গেল। তড়িৎ সুফিয়ানকে জানালেন পাত্রীর কথা। কিন্তু সুফিয়ানের বক্তব্য:
لا حاجة لي فيها .. امرأةٌ نشأت في الخير ملِكة؛ لا تصبرُ على هذا
“তাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। যে নারী এত আরামে বড় হয়েছে সে তো রানীদের মতো জীবনযাপন করে। সে (আমার মতো) এমন জীবন যাপনে ধৈর্য ধরতে পারবে না।”
কোনোভাবেই রাজি হলেন না তিনি। সেই পরিবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে গেল বসরায়।
(ইবনু আবী হাতেমের ’আল-জারহ ওয়াত-তা’দীল: ১/৯০-৯১)
ওপরের ঘটনা ইতিহাসে বিরল নয়। এখানে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় আছেঃ
১) সালাফরা অনেক পরহেজগার ছিলেন। একই সাথে বাস্তববাদীও। বিয়ে-শাদির মতো বিষয়ে তাঁরা যেমন পরহেজগারিতাকে প্রাধান্য দিতেন, তেমনি বাস্তবতাকেও সামনে রাখতেন।
২) কিন্তু হাজার বছর পর এসে আমরা এক অদ্ভুত ধারা চালু করেছি। হাদীসের আক্ষরিক চর্চা করতে গিয়ে একটা কথা ফলাওভাবে প্রচার করি: 'দুনিয়া নয়, দ্বীনদারিতা দেখে বিয়ে করো।' কিন্তু আমরা ভুলে যাই, একজন মানুষের দুনিয়াদারিতা দেখা তার দ্বীনদারি যাচাইয়ের অন্যতম শর্ত। ফলে বিয়ের সময় দ্বীনদারিতা না ঠিকভাবে গণায় ধরা হয়, না বাস্তবতা।
৩) ইসলামে কুফু বিষয়টি মুস্তাহাব হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে, যেগুলো ব্যক্তির অবস্থাভেদে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো খুব জোর দিয়ে মিলিয়ে নেয়া জরুরী। যেমন আর্থিক সামর্থ্য, পরিবারের কাউকে আলাদাভাবে বিশেষভাবে দেখাশোনা করা, ইত্যাদি।
৪) হাতের পাঁচটা আঙ্গুল সমান নয়। তারপরও তারা একসাথে থাকে। কারও সাথে কারও বাধে না। কেন? কারণ, তারা নিজেদের ভিন্নতাকে মেনে নিয়েছে। মেনে নেবার এই চর্চাটা সাংসারিক জীবনেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছু বিষয় থাকে, যা বিপরীত পক্ষের জন্য মেনে নেয়া অত্যন্ত কষ্ঠসাধ্য। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, আর্থিক বৈষম্য। একজন মানুষ ইউরোপে বড় হলে সে ইউরোপিয়ানদের মতই খরচ করতে চাইবে—এটাই যৌক্তিক। তাকে আপনি গুলিস্তানের কাপড় এনে যদি বলেন, পরো, সে হতাশ হবেই। তার মন জয় করতে হলে সে অভ্যস্ত—এমন মানের উপহার দিতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। হ্যা, ব্যতীক্রমও আছে। তবে ব্যতীক্রম কখনও উদাহরণ হতে পারে না।
৫) একটি তিক্ত বাস্তবতা বলি। আমাদের সমাজে এমন অনেক পর্দানশিন বোন আছে, নামাজের ব্যাপারে যত্নশীল, নফল ইবাদতে আগ্রহী, প্রচুর বই পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিভিন্ন কোর্সেও এ্যাক্টিভ থাকার চেষ্টা করেন। বছরে তাদের অনেকেই হয়ত দুই ঈদ ছাড়া মার্কেটে যান। কিন্তু যখনই যান, বাবার পকেট থেকে ৩০-৪০ হাজার, কখনও আরও বেশি টাকার মার্কেট করে ফেরেন। কেউ কেউ তো সাজসজ্জার জিনিসই কেনেন ২০ হাজার টাকার। অভিভাবকের সামর্থ্য ভেদে এটা ভ্যারি করে। এগুলো নিন্দাযোগ্য কিছু না। কিন্তু এই বিষয়গুলো পাত্রীপক্ষের বিবেচনায় রাখা উচিত বিয়ের সময়। সরলমনা মেয়ের জিদ শুনে পরিবারের উচিত নয়, এমন পাত্রের হাতে তাকে তুলে দেয়া যে তার এই ব্যয়বহুল জীবন যাপনের খরচ মেটাতে হিমশিম খাবে। এগুলো বিয়ের আগে লুকিয়ে রাখলে পরবর্তীতে যুলুম পর্যায় নিয়ে যায়।
৬) উভয় পক্ষের সামাজিক রেওয়াজগুলোও স্বচ্ছ থাকা চাই। উদাহরণস্বরূপ, কেউ কেউ সামাজিকতায় এত এ্যাক্টিভ থাকেন যে, নিজ এলাকার রেওয়াজের বাহিরে যাওয়াটাই অসম্মানজনক মনে করেন। কারও স্বামীর আয় অনুযায়ী যদি তার সামর্থ্য থাকে অসুস্থ আত্মীয়ের বাড়িতে ৫০০ টাকার ফলমূল নেবার, তারা এতে প্রচণ্ড আঘাত পান। কারণ, এলাকার বা বংশের নিয়ম অনুযায়ী হাজার টাকার নিম্নে নিতে হয়। এমতাবস্থায় না স্বামী খরচ করে কুলোতে পারেন, না পরিবার তার খরচে খুশী হয়। তাই এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই মেয়েকে বিয়ে দেয়া উচিত।
৭) মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এত আগাম চিন্তা করতে পারে না। দূরদর্শী মানুষ এই সমাজে কম। বিশেষ করে আমাদের সমাজের নব্য দ্বীনে ফেরা অনেক ছেলেমেয়েই বাস্তবতা থেকে বহু দূরে বাস করে।
ফলত একটি মিথ্যা আত্মবিশ্বাস নিয়ে তারা বিয়ে করে চায়; আর তা হলো, 'আমি মানিয়ে নিতে পারব।' কিন্তু মানিয়ে নেয়াটা আদতেও তাদের পক্ষে সম্ভব কিনা—বিয়ের কয়েক বছর যেতেই দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়। ধনী বাবা আজীবন সন্তানদের অভাব বুঝতে না দেয়ায় তারা স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের পর স্বামীর হালাল রোজগারে অভাব খুঁজে পান। বাবার বাড়িতে থাকাকালে বাৎসরিক খরচ কখনও হিসেব করতে না হওয়ায় স্বামীর সংসারে এসে আচানক মাসিক হিসাব দেখে হতাশায় মুর্ছা যান। স্বামীর গায়ে পরিয়ে দেন কিপটামির পোশাক। শত্রু হয়ে যায় স্বামীর পরিবার। জুড়ে দেয়া হয় বেইনসামি, হক নষ্টকারীর মতো নানান ইসলামী টার্ম। এভাবে যুলুম চলতে থাকে, আর ভিক্টিম হয় স্বামী-স্ত্রী দুজনই।
৮) তাহলে সমাধান কী? কুফু মেনটেইন করা। যেমনটা ওপরের গল্পে সুফিয়ান সাওরী বলেছিলেন, 'যে মেয়ে প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়, সে দুনিয়াবিমুখ জীবনে ধৈর্য ধরতে পারবে না।' নিফাকির এই যুগে কুফুর এই বিষয়টি আরও বেশি জরুরী।
প্রয়োজনে খুল্লাম খুল্লা আলোচনা করে স্পষ্ট হয়ে নেয়া। ঘটকের লোভনীয় কথায় বা পাত্রীর আবেগঘন আশ্বাস শুনে কখনই বিবেক হারালে চলবে না।
মনে রাখবেন, আবেগ দিয়ে বিয়ে করা যায়, কিন্তু সংসার চালাতে হয় বিবেক দিয়েই।
– মহিউদ্দীন রূপম
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন